মাজার ও অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপনায় হামলাকারী ব্যক্তিরা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেস্টা করছে। কোনো বিবেকবান মানুষ এমন অপরাধ ও অন্যায়কে সমর্থন করতে পারেন না। অবিলম্বে হামলাকারী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন।
‘বাংলার কোনো বিবেকবান মানুষ এমন গর্হিত অপরাধ ও অন্যায়কে সমর্থন করেন না। যাঁরা এ ধরনের অন্যায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁদের কোনো ধর্মবোধ আছে বলে বিশ্বাস করি না।’ মাজার থেকে শুরু করে অন্য ধর্মাবলম্বীর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়ে যাঁরা আক্রমণ করছেন, তাঁদের কোনো ধর্ম বর্ণ আছে বলে মনে হয় না।
সমাজে অসম্প্রীতি সৃষ্টির অপচেষ্টায় যাঁরা লিপ্ত আছেন, তাঁদের সতর্ক করতে চাই, বাংলার হাজার বছরের সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে ধ্বংস করা যাবে না। এসব কাজ করে কেউ রেহাই পাবেন না। অন্যায়কারীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন।’
সৃষ্টিকর্তা চাইলে সবাইকে একই জাতি, গোত্র ও ধর্মের করে সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা সৌন্দর্য ও ভারসাম্য রক্ষায় সবাইকে আলাদা করে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টিকর্তার এ সৃষ্টিকে অস্বীকার করলে স্রষ্টাকেই অস্বীকার করা হবে।
মাজার বাংলাদেশে আজকে তৈরি হয়নি। কোনো মজার শত বছরের, কোনোটি আবার হাজার বছর আগের। অতীতে এসব মাজারে এমন ধ্বংসলীলা ও তাণ্ডব দেখা যায়নি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে মাজার, মন্দির ও ধর্মের উপাসনালয়কেন্দ্রিক যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, এর তীব্র নিন্দা জানাই।’ সরকারের কাছে মাজারে হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই ।
বাংলায় সুফিদের হাত ধরে, মুসলিম শাসক আসার ৩০০-৪০০ বছর আগে থেকেই সুফিরা ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছেন। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে সুফিদের অবদান অনেক। যাঁরা মাজার ও অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপনায় হামলা করছেন, তাঁরা ইসলামের ইতিহাস জানেন বলে মনে হয় না।
কবর পাকা করা কি হারাম? এটা ইসলামের কোথাও আছে?
বর্তমান সময়ে কবর পাকার বিষয় নিয়ে বহু ওলামায়ে কেরামগনের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে । কেউ কেউ বলেন জায়েজ আবার কেউ কেউ বলেন নাজায়েজ বা বিদআত ! তাই, আমরা বিতর্কে না জড়িয়ে সর্বপ্রথম আমরা আগে দেখব নূর নবীজী (ﷺ) এ ব্যাপারে কিরূপ আমল করতে নির্দেশ দিয়েছেন ।
নূর নবীজী (ﷺ) এর অসংখ্য সহীহ হাদিস শরীফ সমূহ থেকে জানা যায় আল্লাহর মু`মিন বান্দাহগনের কবর পাকা করা জায়েজ ও মুস্তাহাব । বহু শক্তিশালী সনদের হাদীস শরীফ থেকে নূর নবীজী (ﷺ) এবং সাহাবায়ে কেরামগন এরূপ কবর পাকা করেছেন বলে প্রমান পাওয়া যায় । নূর নবীজী (ﷺ) ও সাহাবায়ে কেরামগনের যমানায় কবরকে সামান্য উঁচু করার প্রচলন ছিল । এমনকি সাহাবায়ে কেরামগনের যুগেই স্বয়ং নূর নবীজী (ﷺ) এর রওজা মুবারাক, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) ও হযরত উমার (رضي الله عنه) এর মাজার শরীফদ্বয় উঁচু ছিল ।
যেমন, এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে এসেছে –
عن القا بن محمد قل : دخلت علی عا ءشۃ: يا اماه اكشفي لي عن قبر النبي صلی ﷲ عليه وسلم وصا حبيه فكشفت لي عن ثلاثۃ قبورلا مشرفۃ ولا لاطءۃ مبطوحۃ ببطحاء العرصۃ الحمراء ,
হযরত কাশিম (رضي الله عنه) বর্ননা করেন,একদা আমি মা আয়েশা (رضي الله عنه) এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললাম,ওহে মা ! আপনি আমার জন্য রাসূল (ﷺ) ও তার দুই সাহাবীর মাজারদ্বয় উন্মোচন করুন এবং তিনি তাই করলেন । আমি দেখি ঐ কবর শরীফগুলো বেশী উঁচুও ছিল না আবার নিচুও ছিল না । কবর গুলোর উপর ময়দানের লাল কাকর ছড়ানো ছিল । `
১.সুনানে আবী দাউদ, হাদিস নং-৩২২৫,
২.মুস্তাদরাক আল হাকেম, হাদিস নং-১৩৬৮,
৩.ইমাম বাগভী: শরহে সুন্নাহ, ৫ম খন্ড, ৪০২ পৃষ্ঠা,
৪.ইমাম বায়হাকী: সুনানে কুবরা, হাদিস নং-৬৭৫৮,
৫.মেশকাত শরীফ,১৪৯ পৃষ্ঠা হাদিস নং-১৭১২,
৬.ইমাম মোল্লা আলী কারী; মেরকাত শরহে মেশকাত,৪র্থ খন্ড, ১৬৯পৃষ্ঠা,
৭.আশিয়াতুল লুময়াত : ইমাম যায়লায়ী: নাছবুর রায়া, ২য় খন্ড, ৩০৪ পৃষ্ঠা।
❏ এই হাদিস সম্পর্কে ইমাম হাকেম ও ইমাম যাহাবী (رحمة الله) বলেন,
هذا حديث صحيح اءاسناد
– এই হাদিসের সনদ সহীহ। (মুস্তাদরাকে হাকেম,হাদিস নং-১৩৬৮)
❏ ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) বলেন,
وقال البيهقي حديث القاسم بن محمد في هذا الباب اصح,
– ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) বলেন, এ বিষয়ে কাশেম ইবনে মুহাম্মাদ (رحمة الله) এর রেওয়ায়েতটি সহীহ ।
( মুহাররার ফিল হাদিস, 546 নং হাদিস )
সুতরাং, এই হাদিস সর্বসম্মতিক্রমে সহীহ । অতএব,এই হাদিস দ্বারা প্রমানিত হয়, কবরের উপর কাকর বা কংক্রিট ব্যবহার করা জায়েজ । কারন, এরূপ ময়দানের লাল কংক্রিট বা কাকর স্বয়ং নূর নবীজী (ﷺ) সহ হযরত আবু বকর(رضي الله عنه) ও হযরত উমর (رضي الله عنه)
এর মাজারত্রয়ে ব্যবহার করা হয়েছে ।
❏ এ সমন্ধে আরেকটি রেওয়ায়েত লক্ষ করুন,
وعن جعفر بن محمد عن ابيه مرسلا ان النبي صلی ﷲ عليه وسلم حثا علی الميت ثلاث حثيات بيديه جمعيعا وانه رش علی قبر ابنه ابرهيم ووضع عليه حصباء,
হযরত জাফর ইবনে মুহাম্মাদ তার পিতা হতে বর্ননা করেন, নবী কারীম (ﷺ) এক কবরের উপর মুঠ করে পানি ছিটিয়েছেন এবং ঐ কবরের উপর কাকর (কংক্রিট) স্থাপন করেছেন । `
১.ইমাম বাগভী: শরহে সুন্নাহ,হা:নং-১৫১৫।
২.মুসনাদে শাফেয়ী, ১ম খন্ড, ৩৬০ পৃষ্ঠা।
৩.মেশকাত শরীফ, ১৪৮পৃষ্ঠা।
৪.ইমাম মোল্লা আলী কারী : মেরকাত শরহে মেশকাত, ৪র্থ খন্ড, ১৬৫ পৃষ্ঠা।
বর্ননাকারী তাবেঈ নির্ভরযোগ্য হলে সর্বসম্মতিক্রমে মুরছাল হাদিস হুজ্জত বা দলিল হয় । এই হাদিস দ্বারা প্রমানিত হয় যে, সম্মানিত ব্যক্তির কবরের উপর কাকর বা কাকরের কংক্রিট ব্যবহার করা স্বয়ং নূর নবীজী (ﷺ) এর সুন্নত । কারন,নূর নবীজী (ﷺ) তিনি নিজেই তার পুত্র হযরত ইব্রাহিম (رضي الله عنه)এর মাজারের উপর এরূপ কংক্রিট ব্যবহার করেছেন ।
❏ আল্লামা আলাউদ্দিন কাছানী হানাফী (رحمة الله) উল্লেখ করেন,
عن سعيد بن العاص انه قل اجعلوا علی قبري اللبن والقصب , كما جعل علی قبر رسولﷲ صلیﷲعليه وسلم وقبر ابي بكر وقبر عمر
হযরত সাদ ইবনে আস (رضي الله عنه) বর্ননা করেন, নিশ্চয়ই তিনি বলেছেন,`তোমারা আমার কবরে কাঁচা ইট স্থাপন করবে, যেমনিভাবে রাসূল (ﷺ), হযরত আবু বকর ও উমর (رضي الله عنه) এর মাজারত্রয়ে দেওয়া হয়েছে । `
(ইমাম কাছানী : কিতাবুল বাদাউছ ছানায়ে, ২য় খন্ড, ৬১ পৃষ্ঠা )
এই হাদিস দ্বারা প্রমানিত হয়, নূর নবীজী(ﷺ),হযরত আবু বকর সিদ্দীক(رضي الله عنه), হযরত উমর(رضي الله عنه) এবং হযরত সাদ ইবনে আস (رضي الله عنه) প্রমূখ সাহাবায়ে কেরামগন তাদের মাজার শরীফ পাকা করেছেন বা পাকা করার পক্ষে ছিলেন । সুতরাং, হক্কানী ব্যক্তিগনের কবর পাকা করা সাহাবায়ে কেরামগনের সুন্নত । এমনকি স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (ﷺ) তিনি নিজে তার পুত্র হযরত ইব্রাহিম (رضي الله عنه) এর মাজারে ময়দানের কাকর স্থাপন করেছেন । তাই,ইহা নূর নবীজীর সুন্নতও বটে ।
নূর নবীজী (ﷺ) এর পাশাপাশি হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) ও হযরত উমর (رضي الله عنه) এর কবরদ্বয়ও পাকা করা ছিল এবং আজও পর্যন্ত আছে । সুতরাং, খাস ব্যক্তিগনের জন্য ইহা একটি উত্তম কাজ ।
বাংলায় ইসলাম প্রচারে পীর-আউলিয়াদের ভূমিকাঃ একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ
বাংলায় ইসলাম প্রচারের প্রসঙ্গ এলে একটা পক্ষ কোনোকিছু না ভেবে সোজাসাপটা বলে বসে – মুসলিম শাসকরাই এতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। একই পক্ষের দাবিতে দ্বিতীয় স্থানে আছেন আরব বণিকরা। কিন্তু বাংলায় ইসলাম প্রচারে সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা রাখা পীর-আউলিয়াদের নাম নিতে তাদের রহস্যময় অনীহা লক্ষ্যনীয়। আলোচনার কোনো এক কোণে তাঁদের প্রসঙ্গ আনলেও তা নিতান্ত গৌণ। বিষয় হিসেবেই উপস্থাপন করতে দেখা যায়। অথচ মুসলিম শাসকরা শাসন প্রতিষ্ঠা করলেও ইসলাম প্রচারে তাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেই বললেই চলে। অপরদিকে আরব বণিকরা প্রাচীনকাল থেকে এদেশে বাণিজ্যের প্রসার ঘটালেও ইসলাম ধর্মপ্রচারে তাদের ভূমিকা নিতান্তই সামান্য।
বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা বাংলায় সফরকালে পনেরো দিনব্যাপী মেঘনা নদী হয়ে ভ্রমণ করেন। ভ্রমণেশেষে এ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “মুসলিম শাসনাধীন কাফেরদের অঞ্চল।” ইবনে বতুতা, ১৯৬৯, পৃষ্ঠা ২৬৭। উল্লেখ্য, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বঙ্গবিজয় করেন ১২০৩ সালে, আর ইবনে বতুতা বাংলায় আসেন ১৩৪৬ সালে। মাঝে প্রায় দেড়শ বছর। এ থেকে প্রথমত মুসলিম শাসকদের ইসলাম প্রচারের ভূমিকা কতটুকু তা স্পষ্ট হয়ে যায়, দ্বিতীয়ত নাস্তিক ও হিন্দুদের আপত্তি তরবারির জোরে এ-দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা মুসলিম শাসকরা গণহারে হিন্দু-বৌদ্ধদের ধর্মান্তরিত করেছে—এ ধরনের আপত্তিও মাটিচাপা পড়ে যায়। কারণ, গণহারে ধর্মান্তরিত করা হলে বাংলায় মুসলমান সংখ্যাধিক্য হতে দেড়শ বছর লাগার কথা না। মজার বিষয় বাংলায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে উনিশ শতকে। (H. Brverley, census of bengal, 1872) ততদিনে বাংলায় মুসলিম শাসন পেরিয়ে বৃটিশ শাসন কায়েম হয়ে গেছে। তারমানে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার প্রায় সাতাশ বছর লেগেছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে। মুসলিম শাসকরাই যদি এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে ধর্মান্তর প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতেন, তবে দীর্ঘ সাতাশ বছরে অন্য ধর্মাবলম্বী খোঁজে পাওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়তো। হ্যাঁ, বিচ্ছিন্ন দুয়েকটি ঘটনা ইতিহাসে এমন পাওয়া যায় বটে, কিন্তু সামগ্রিক ইতিহাস এ কথা কখনোই প্রমাণ করে না। পুরো ভারতবর্ষের ইতিহাসে একবার চোখ বুলালেও বিষয়টা জলবৎ তরলং হয়ে যায়। দীর্ঘ সাড়ে ছয়শ বছর রাজ করেও দিল্লিতে মুসলিমরা ছিল সংখ্যালঘু।
কথায় কথায় আসে আরব বণিকদের কথা। ব্যবসার উদ্দেশ্যে প্রাচীনকাল থেকে তাদের আগমন। কিন্তু ইসলাম প্রচারে তাদের অবদান সে অর্থে খুব বেশি নয়। একটি বিষয় এ কথা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। বণিকরা প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা চেনেন, জানেন। বাণিজ্য করেছেন বছরের পর বছর। কারো কারো বসতবাড়িই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বঙ্গে। অথচ, তারা কখনো স্থানীয়দের এইটুকু প্রভাবিত করতে সমর্থ হননি যে, দীর্ঘ এ ব্যাবসায়ী যাত্রায় বহুসংখ্যক তিনধর্মীকে মুসলিম করে তুলবেন। যদি তা-ই হতো, তবে এ দেশের অধিকাংশ মুসলিম হতো শাফেয়ি মাজহাবের অনুসারী। কেননা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বণিকদের অধিকাংশ শাফেয় মাজহাবের অনুসারী: (বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ, তৃতীয় সংস্করণ ২০২২, আকবর আলি খান, প্রথমা প্রকাশন।)
অপরপক্ষে পীর-আউলিয়াদের ভূমিকা এ দেশের মাটি-জলে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। দেশজুড়ে বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য মাজার, খানকাহ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজকাল এক শ্রেণির মানুষ অি মুসলিমদের কথায় কথায় মাজারপূজারী বলে তাচ্ছিল্য করে স্বর্গসুখ লাভ করতে দেখা যায়। অথচ ইসলামের প্রচার-প্রসার কিংবা ভিনধর্মীদের মুসলিম বানানোর ক্ষেত্রে শুধু পীর-আউলিয়ারাই নন, তাঁদের মাজারেরও বিরাট ভূমিকা রয়েছে। ডিসকাভারি অফ বাংলাদেশ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দীর্ঘ সময় ধরে পীরদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তিরা ধর্মান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। এই মিথস্ক্রিয়া শুধু জীবিত পীরদের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, এই মিথস্ক্রিয়া মৃত পীরদের মাজারের সঙ্গেও চলে। ব্যক্তিপর্যায়ে ধর্মান্তরে কয়েক শ বছর লাগতে পারে। গোত্র ধর্মান্তর অল্প সময়ে হতে পারে। গোত্র ধর্মান্তরের জন্য প্রয়োজন উপজাতি বা গ্রাম সমাজের মতো জনগোষ্ঠী। এ ধরনের জনগোষ্ঠী বাংলায় আদৌ ছিল না।” (ডিসকভারি অফ বাংলাদেশ, আকবর আলি খান।)
উল্লিখিত তথ্য থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, পীর-আউলিয়ারা নন কেবল, ইসলাম প্রচারে তাঁদের মাজারেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বলা বাহুল্য মাজারে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল জাতের মানুষের যাতায়াত উন্মুক্ত। ভিনধর্মী হওয়া সত্ত্বেও মাজার ওয়ালার কাছ থেকে ফয়েজ কিংবা উপকৃত হওয়ার দৃষ্টান্ত অহরহ। আর এভাবেই বাংলার মানুষ ইসলামের প্রতি উদ্দীপ্ত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন।
উদাহরণ দেওয়া যায় সিলেট-বিজেতা হজরত শাহ জালাল (রা.) কে। তিনি যখন সেনাপতি নাসির উদ্দিন সিপাহসালারের সঙ্গে সিলেট যাত্রা করেন, তখন সিলেটের রাজা ছিল গৌড় গোবিন্দ। শেখ বোরহান উদ্দিন রহ, পুত্রের আকিকায় গরু জবেহ করেছিলেন বলে পুত্রকেই শহিদ করে দেয় অত্যাচারী হিন্দুরাজা। অতঃপর শাহ জালালের সিলেট জয়ের পর তিনি আর তাঁর মুরিদ-খলিফাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে ধীরে ধীরে পুরো সিলেটবাসী ইসলামের ছায়াতলে আসতে থাকে। বলা বাহুল্য এটিও দিনেদিনে হয়ে যায়নি, শাহজালালের উত্তরসূরীরাও কালের পর কাল ধর্মপ্রচারে নিরলস ব্রতী হয়েছেন। (জালালাবাদের কথা, দেওয়ান নুরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী।)
সিলেট ছেড়ে রাজশাহী অঞ্চলে দৃষ্টি দিলে প্রথমে নজর পড়বে শাহ মখদুম রহ এর মাজারের দিকে। ইতিহাস বলছে, দু-দুজন প্রতাপশালী হিন্দুরাজার সঙ্গে যুদ্ধ করে রাজশাহী জয় করেছিলেন তিনি। এবং তাঁর পক্ষ হয়ে যারা যুদ্ধ করেছিলেন, তারা কেউ-ই বহিরাগত নয়, সবাই তাঁর আদর্শ ও আধ্যাত্মিকতায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম কবুল করা মুসলিম। শুধু মুসলিম নয়, ইসলাম কবুল না করলেও অনেক ভিনধর্মী তাঁর পক্ষ নিয়েছিলেন শুধু আদর্শগত কারণে। পরবর্তীতে তাঁকে আর তাঁর মাজারকে ঘিরে রাজশাহী অঞ্চলে ইসলামের বিপ্লব সাধিত হয়। (শাহ মখদুম রূপোশ যুগ মানস (২য় সংস্করণ)। শাহ মখদুম রূপোশ দরগা এস্টেট, রাজশাহী।মোঃ আবুল কাসেম।) এভাবে খুলনা অঞ্চলে খান জাহান আলী রহ. এর কথা কে না জানে। তাঁর সমাজ-সংস্কারের কথা ইতিহাসে অমলিন। ইতিহাসবিদ ইটন তাঁকে 'entrepreneur peer' তথা 'উদ্যোক্তা পীর' বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর সম্পর্কে ইটন আরো লিখেছেন, “khan jahan was clearly an effective leader, since superior organisation skills and abundant manpower were necessary for transforming the region's formerly thick jungle into rice field: the land had to be embanked along streams in order to keep the salt water out, the forest had to be cleared, thanks had to be dug for water supply and storage, and huts had to be built for the workers." (Richard m Eaton 1994, p 210)
ইটনের উদ্ধৃতিতে দেখা যায় খানজাহান আলী রা, শুধু ইসলাম প্রচারে ক্ষান্ত হননি, তিনি সমাজ বিনির্মানে উদ্যোগী হয়েছিলেন। মানুষের প্রয়োজনে বনজঙ্গল কেটে বসতি, রাস্তাঘাট, পানির প্রয়োজনে দিঘি খনন ইত্যাদি কাজে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। বস্তুত পীর, আউলিয়া কিংবা সুফিরা আদর্শগতভাবেই সমাজ বিনির্মাতা। তাঁরা মানুষকে শুধু আধ্যাত্মিক প্রেরণাই দেননি, বেঁচে থাকার জন্য সুস্থ সামাজিক পরিবেশও সৃষ্টি করে দিয়েছেন।
প্রাচীনকাল থেকে রাজা-বাদশাহ, নবাব-জমিদারদের বাসস্থান ঢাকা অঞ্চলেও পীর আউলিয়ারা ইসলাম প্রচারে এগিয়ে। বাবা আদম শহিদ রহ., শাহ সুলতান বলখি রহ., শাহ আলী বোগদাদি রহ., সায়্যিদ শাহ নেয়ামত উল্লাহ বুৎ-সাকেন রহ., শেখ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা রহ. (নারায়ণগঞ্জ) সহ অসংখ্য পীর-আউলিয়ার ইসলাম প্রচার ঢাকাকে সমৃদ্ধ করেছে।
অলি-আল্লাহদের পুণ্যভূমি চট্টগ্রামের কথা না বললেই নয়। বদর পীরের চাটগাঁ এখন 'মদিনাতুল আউলিয়া' নামে খ্যাত। বছরের পর বছর পীর আউলিয়ারা সেখানে নিজেদের বসতি স্থাপন করেছেন। হিন্দু-অধ্যুষিত অঞ্চলে তাওহিদের কাতা উড়িয়েছেন। গরিব উল্লাহ শাহ, আমানত শাহ, মিসকিন শাহ, শাহ মোহসেন-সহ অগুনতি আউলিয়ায়ে কেরামের আবাসভূমি চট্টগ্রাম। তাঁদের বৈপ্লবিক প্রচেষ্টায় এই গুলজারে সিরিকোট অঞ্চলে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত। তবে এ অঞ্চলে পুরোপুরি ইসলাম প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড়ো বিপ্লব সংগঠিত হয় উনিশ শতকে মাইজভাণ্ডারী তরিকা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। গাউছুল আজম হজরত আহমদুল্লাহ ক. এবং গোলামুর রহমান ক. মাইজভাণ্ডারীর আধ্যাত্মিক প্রভাব চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। তাঁদের প্রেমময় তরিকার মাধ্যমে দলে দলে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে ভীড় করে। তাঁদের আবির্ভাবের আগে চট্টগ্রামের মুসলিমদের হার যেখান ৬০-৬৫ শতাংশ, সেখানে একশ বছরের ব্যবধানে মুসলিমদের হার ৮০-৮৫ শতাংশে রূপ নেয়। (H. Brverley, census of bengal, 1872 ) উল্লেখ্য, এদেশে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করা পীর-আউলিয়ারাই কেবল ইসলাম প্রচারে ভূমিকা রাখেননি, বরং অস্থায়ীভাবে আসা পীর-আউলিয়ারাও যুগে যুগে ইসলাম প্রচারে ভূমিকা রেখেছেন। চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হজরত আহমদ শাহ সিরিকোটি রহ, এবং তাঁর বংশধরদের ভূমিকা সবার নখদর্পনে।
সুতরাং বাংলায় ইসলাম প্রচার পীর-আউলিয়া তথা সুফি-সাধকদের ভূমিকা সর্বাগ্রে। সুদীর্ঘ সময় ধরে তারা বাংলার মাটি-জলে একাকার হয়ে এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করেছেন। একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করি— “বাংলায় ইসলাম প্রচার করেছেন মূলত সুফি সাধকেরা। এঁরা সমুদ্রপথে বাংলায় আসেননি, এসেছেন স্থলপথে। ত্রয়োদশ শতকে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ অনেক বেড়ে যায়। তাই অনুমান করা হয় যে, ত্রয়োদশ শতক থেকে শুরু করে বাংলাদেশে বড় ধরনের ধর্মান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলায় ইসলাম দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েনি, এ পক্রিয়া অত্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে চলে।” বাংলায় ইসলাম প্রচার সাফল্য, আলি আকবর খান।
লিখক: সাংবাদিক শাহ্ মোঃ দিদার হোসেন,
প্রকাশক/সম্পাদক, সি এন আই ২৪ ডট কম।