আন্তর্জাতিক ডেস্ক:- বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার একটি মানবপাচারকারী চক্র ‘রোহিঙ্গা’ সাজিয়ে বাংলাদেশিদের অস্ট্রেলিয়ায় পাচার করছে। এ চক্রে রয়েছে কিছু অসাধু বাংলাদেশি ও ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক এবং কয়েকজন রোহিঙ্গা শরণার্থী। ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ অস্ট্রেলীয় পুলিশের সহায়তায় চক্রটির বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছে। গোটা ঘটনার তদন্ত কাজে দেশটিকে সহযোগিতা করছে নিউজিল্যান্ডের পুলিশ ও ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি।
মঙ্গলবার (২৪এপ্রিল) অস্ট্রেলীয় সংবাদ মাধ্যম এবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে। এবিসি নিউজের ইন্দোনেশীয় প্রতিনিধি অ্যাডাম হার্ভের প্রতিবেদনটিতে ‘আসল রোহিঙ্গা’দের পাশাপাশি বাংলাদেশিদেরও রোহিঙ্গা সাজিয়ে পাচার করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে সেনা নিপীড়ন শুরু হলে বাংলাদেশের দিকে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। পাশাপাশি অল্পসংখ্যক রোহিঙ্গা বিপজ্জনক সাগর পাড়ি দিয়ে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়ার জেলেরা দুই দফায় এ রকম প্রায় দেড় শতাধিক রোহিঙ্গাকে নৌকাসহ সাগর থেকে উদ্ধার করে।
এবিসি নিউজ বলছে, আসল রোহিঙ্গাদের আড়ালে কিছু সংখ্যক বাংলাদেশিদেরও রোহিঙ্গা বানিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় পাচারের কথা তারা নিশ্চিত হয়েছে। ইন্দোনেশিয়াকে মানবপাচারের ট্রানজিট রুট ব্যবহার করে চক্রটি তাদের অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে পাচারের চেষ্টা করে।
ইন্দেনেশিয়ার পুলিশের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হেরি রুডলফ নাহাক জানিয়েছেন, এএফপি ও নিউজিল্যান্ড পুলিশের সহায়তায় পাচারকারীদের বিরুদ্ধেে একটি আন্তর্জাতিক অভিযান চালানো হয়েছে। পাচার চক্রে জড়িত তিন সন্দেহভাজনকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজন রোহিঙ্গাও রয়েছে।
ইন্দোনেশীয় পুলিশ বলছে, মানব পাচারকারীদের শিকার ব্যক্তিদের ভুয়া নথিপত্র তৈরি করে স্পিডবোটে করে মালয়েশিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া নিয়ে আসা হয়। এরপর কালিমানতান ও জাভা হয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তাদেরকে অস্ট্রেলিয়ার নিকটবর্তী পাপুয়া নিউগিনির মেরাউকিতে পাচার করা হয়। এরপর স্থানীয় মাছধরার নৌকা ভাড়া করে এদেরকে অস্ট্রেলিয়া পাঠানো হয়।
ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ প্রধান নাহাক বলেন, চক্রটির মূল হোতা একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী। ইন্দোনেশীয় ভাষায় পারদর্শী ওই শরণার্থী দীর্ঘদিন ধরে দেশটিতে বাস করছিল। পরে সে বাংলাদেশিদের অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর চক্রটি গড়ে তোলে।
স্থানীয় ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় কিছু বাসিন্দাও পাচারের শিকার এসব মানুষের জন্য চাঁদা তুলে বিমানের টিকিট কিনে দিয়েছিল। মিয়ানমারে নিপীড়নের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য ইন্দোনেশিয়ার মানুষ সহানুভূতিশীল। আর মানাবপাচারে এটিই কাজে লাগাচ্ছে ওই চক্র।
সন্দেহভাজন তিন পাচারকারীর অপর দুজন বাংলাদেশি ও ইন্দোনেশীয়। পুলিশ তাদের কাছ থেকে কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম কার্ড, বিমানের টিকিট ও ১৬ হাজার অস্ট্রেলীয় ডলার সমমূল্যের মুদ্রা উদ্ধার করেছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না মিয়ানমার সরকার। আর সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে চার দশক ধরে পাশর্^বর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্যে একটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার কথিত অভিযোগ তুলে সেনা অভিযানের নামে নৃশংসতা শুরু হলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এদের সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এদের আশ্রয় হয়েছে কক্সবাজারে উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন ক্যাম্পে।
রোহিঙ্গাদের স্রোত শুরু হওয়ার পর বিষয়টি বাংলাদেশ তোলে জাতিসংঘে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও প্রথমে রোহিঙ্গা নির্যাতনের কথা স্বীকার না করলেও পরে ‘কিছু হত্যার’ বিষয়টি স্বীকার করেন দেশটির সেনা প্রধান।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দিতে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রথমে সমঝোতা স্মারক এবং পরে ফিজিক্যাল অ্যারাঞ্জমেন্ট নামে চুক্তিও হয়েছে। প্রত্যাবাসনের প্রথম ধাপ হিসেবে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারকে আট হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার তালিকাও দেয়া হয়। যদিও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ যাচাই বাছাইয়ের নামে সেখান থেকে মাত্র তিনশ মতো রোহিঙ্গাকে তাদের নাগরিক বলে দাবি করে।
গত সপ্তাহে মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী প্রথমবারের মতো একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে রোহিঙ্গাদের দেখতে বাংলাদেশ সফর করে। তারা কক্সবাজারের ক্যাম্পে গিয়ে রোহিঙ্গাদের দুর্দশাও দেখে।
দেশে ফিরে গিয়ে ২১ এপ্রিল ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে’ বলে মিথ্যাচার করেন তিনি। ইয়াঙ্গুনে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি জানান, ‘রোহিঙ্গাদের ফেরাতে তারা (মিয়ানমার) বাংলাদেশকে একটি যাচাই ফরম বিতরণ করতে বলেছিল। অথচ বাংলাদেশ সে কাজে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।’
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদেরকে ফিরিয়ে না নিয়ে নানা তালবাহানা করছে- একথা জানিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই বাস্তবতায় রোহিঙ্গাদের জন্য মানসম্পন্ন আশ্রয় প্রকল্প নির্মাণে সরকারকে বিপুল অংকের টাকাও ব্যয় করতে হচ্ছে।