অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাত মাসে দু’টি বড় সাফল্য জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। এর একটি অনিয়ন্ত্রিত দ্রব্যমূল্যকে মাহে রমজানের শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণে আনা এবং ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ এর মধ্য দিয়ে দেশের পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের অস্থিতিশীলতা তৈরির পরিকল্পনা ভেঙ্গে দেয়া।
দু’সপ্তাহ আগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক সম্মেলনের পর থেকে দেশের জেলা প্রশাসকরা নিজ নিজ জেলায় এই দু’টি বিষয়সহ সরকারের নির্দেশনা নিয়ে সাড়াঁশি অভিযান চালানোর ফলে দ্রব্যমূল্যের বাজার ও জনজীবনে দৃশ্যমান স্বস্তি দেখা যাচ্ছে। জেলা প্রশাসকরা বাজার তদারকির পাশাপাশি চালিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। পুলিশ প্রশাসন চালিয়েছে সন্ত্রাসীদের নির্মূলে ‘ডেভিল হান্ট’ অপারেশন।
রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের একগুচ্ছ নির্দেশনা নিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত তিনদিনের জেলা প্রশাসক সম্মেলন শেষে জেলা প্রশাসকরা নিজ নিজ জেলায় ফিরে গেছেন দুই সপ্তাহ আগে।
তাদের নেয়া প্রথম দু’টি চ্যালেঞ্জ ছিল মাহে রমজানকে সামনে রেখে দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ। এই দু’টি অভিযানে জেলা প্রশাসকসহ সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কঠোর পদক্ষেপে দেশের রাজনৈতিকদল, পেশাজীবী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো দৃশ্যমান সাফল্য দেখতে পাচ্ছেন বলে অভিমত দিয়েছেন বিভিন্ন অংশীজনরা।
দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার লক্ষ্যে পতিত আওয়ামী লীগের ব্যবসায়িক বেনিফিশিয়ারি সিন্ডিকেট মাহে রমজানকে সামনে রেখে বাজার অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনার পাশাপাশি চুরি-ডাকাতিসহ আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিল। অন্তর্বর্তী সরকার জেলা প্রশাসক সম্মেলনে এই বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার বার্তা দেয়ার পর জেলা প্রশাসকরা নিজ নিজ জেলায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সাড়াঁশি অভিযান শুরু করে অভিযান চলমান রেখেছেন।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম জানিয়েছেন, আড়তদার মজুদদারদের বিরুদ্ধে কোনো অনুকম্পা নেই। ‘রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের আইন শক্তিশালী, নাকি আড়তদার-মজুতদার ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠি শাক্তশালী-এই চ্যালেঞ্জ নিতে চাই।’ রোজা শুরুর আগেই সতর্কবার্তা দিয়ে ব্যবসায়ীদের সাথে চার দফা বৈঠক করেছি। অনুনয় বিনয় করে বলেছি, মজুত করে চাল, ডাল, তেল, চিনির কৃত্রিম সংকট তৈরি করবেন না। দেখা গেছে, সব পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক থাকলেও সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। বাণিজ্যিক রাজধানী বন্দর নগরী চট্টগ্রামের পাইকারী হাব হিসেবে পরিচিত খাতুনগঞ্জে গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনসহ অভিযান চালিয়েছি। এই সময় ব্যবসায়ীরা ঘোষণা দিয়েছেন, ১৬০ টাকা দরে তারা সয়াবিন তেল বিক্রি করবেন। কোনো পণ্যের মজুতদারকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া হবে না। গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছি। প্রয়োজনে তাদের আইনের আওতায় এনে জেলে ঢুকানো হবে।
তিনি বলেন, এই পর্যন্ত ৪০টি ভ্রাম্যমাণ অভিযান পরিচালনা করেছি। রমজান মাসে ৪শ’ ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযানের পরিকল্পনা আছে। কোনো ছাড় দেয়া হবে না। আইনশৃংখলা পরিস্থিতির বিষয়ে সমন্বয় করা হচ্ছে আইনশৃংখলা বাহিনীর সাথে।
কয়েকজন জেলা প্রশাসকের সাথে এরইমধ্যে আলোচনা করে জানা গেছে, তারা প্রধান উপদেষ্টার গঠন ও দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা নিজেকে টিম লিডার হিসেবে উল্লেখ করে বলেছিলেন ‘সরকারকে যদি একটা ক্রিকেট বা ফুটবল টিমের সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে এটা একটি টিম। এই সরকারের ছয় মাস চলে গেলো, এটাকে আমি বলছি সরকারের প্রথম পর্ব। প্রথম পর্বের কোনো ভূল থাকলে সেটাকে ঠিকঠাক করে এখন আমরা খেলার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। এখন কাজ হলো কর্মপদ্ধতি ঠিক করা। খেলা হলো একটা সামগ্রিক বিষয়, একজনের ভূলের কারণে অন্যরা সাফল্য থেকে বঞ্চিত হয়। পুরো টিমের সাফল্যটা গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। প্রস্তুতির কোথাও ঘাটতি থাকলে সেটাকে পূরণ করা দরকার’। ‘আমি প্রধান অতিথি নই, আমাকে এই টিমের একজন লিডার বা ক্যাপ্টেন বলতে পারো। জেলা প্রশাসকরা নিজ নিজ জেলায় একেকজন সরকার। আপনারাই সরকারের প্রতিনিধি।’
প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যকে সন্তানদের প্রতি পিতার অভিভাবক্ত ও দায়িত্বের সাথে তুলনা করেন জেলা প্রশাসকদের মন্তব্যে।
প্রধান উপদেষ্টা জেলা প্রশাসকদের ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে নিজের মতো করে মাঠ প্রশাসন পরিচালনা করার আহ্বান জানানোয় সরকারের উপ-সচিব ও যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা সম্মানিত হয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জেলা প্রশাসক বলেন, আমরা জেলার দায়িত্ব পালন করলেও প্রকৃত অর্থে প্রশাসনের মধ্যমস্তরের কর্মকর্তা। আমরা গর্বিত, বিশ্বের কাছে সমাদৃত একজন নোবেল বিজয়ী এবং অর্থনীতির অধ্যাপককে আমাদের দেশের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে পেয়েছি। এটি আমাদের জন্য সৌভাগ্যের। তাঁর সম্মান রক্ষায় আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, দুই সপ্তাহ আগে দেশের জেলা প্রশাসকরা শপথ নিয়ে ঢাকা থেকে নিজ নিজ জেলায় ফিরেছি। আমাদের প্রথম কাজ ছিল মাহে রমজানকে সামনে রেখে তেল, চিনি, চাল, ডালসহ নিত্য পণ্যের সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেয়া। আড়তদার এবং মজুতদারের কারসাজিতে অতীতের ন্যায় রমজান মাসে অতি-মুনাফাখোরদের হাত থেকে ভোক্তাদের রক্ষা করায় ছিল প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ।
ডিসি সম্মেলনে আলোচনার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার এবং ফোকাল পয়েন্ট ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আড়তদার ও মজুতদারদের শনাক্ত করে তাদের সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেয়া, আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন, রাষ্ট্রকে ব্যর্থ করার জন্য পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের আইনের আওতায় আনাসহ বিভিন্ন পরামর্শমূলক প্রস্তাবনা।
উদ্বোধনী অধিবেশনে অন্তর্বর্তী সরকারের ফোকাল পয়েন্টগুলো স্পষ্টভাষায় উপস্থাপন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাবৃন্দ এবং সরকারের নীতিনির্ধারণী পদে অভিষিক্ত ব্যক্তিবর্গও বিভিন্ন সেশনে বক্তব্য রাখেন। তিন দিনের জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ৩০টি ভিন্ন ভিন্ন সেশনে আলোচনা হয়েছে সংস্কার, বৈষম্যের অবসান, জাতীয় ঐক্য, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও সমাজ ব্যবস্থা, একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণের আকাঙ্খার প্রতিফলন, ন্যায় বিচার। আলোচনা হয়েছে জেলা প্রশাসকদের দায়িত্বশীলতা, কর্তব্য, মানুষের সাথে সম্পৃক্ততা, সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের কাছে সরকারের বার্তা পৌঁছে দিয়ে সেতুবন্ধন তৈরি করা।
জেলা প্রশাসকরাও দিয়েছেন বিভিন্ন মতামত। একেক জেলার একেক রকম সমস্যা। জেলা প্রশাসকরা তুলে এনেছেন এসব সমস্যাবলি। উপস্থাপন করেছেন সরকারের সামনে।
মতবিনিময় করেছেন অন্যান্য সতীর্থ জেলা প্রশাসকদের সাথে। ফলে জুলাই বিপ্লবের চেতনায় উদ্ভাসিত বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্খা ও অন্তর্বর্তী সরকারের দেশ গড়ার পরিকল্পনায় দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে সরকার সফল হবে। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশন তুলে নেয়া হয়েছে। জুলাই শহীদ ও জুলাই যোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস-এর সেক্রেটারি এডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বলেন, সরকারের পদক্ষেপে আমরা খুশি। পতিত স্বৈরাচার ছাড়া দেশের রাজনৈতিকদলগুলোর মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কার ও রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে আশা করা যায়, দেশ আগামী দিনে সঠিক ট্র্যাকে উঠে যাবে। দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বে আমাদের মর্যাদাকে উচ্চাসনে নিয়ে যেতে পারবো।