পরিবারের সবাইকে হারানোর মর্মযাতনা কাউকে বলে বোঝাতে পারবো না : প্রধানমন্ত্রী
নিজস্ব প্রতিনিধি: –
১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, নির্বাসিত জীবন-যাপনসহ নিজের দুঃখগাথা শোনালেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এসময় আবেগে বার বার তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। পরিবারের সবাইকে হারানোর মর্মযাতনা কাউকে বলে বোঝাতে পারবেন না বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর দীর্ঘ স্মৃতিচারণায় অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন উপস্থিত নেতাকর্মী ও সুধীজনেরাও।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর নিজের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে বুধবার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় এসব কথা বলেন তিনি। বুধবার গণভবনে আয়োজিত ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি আরো বলেন, আসলে ঘরের শত্রু বিভীষণ। স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের জন্য দলের ভেতরের মানুষদের ষড়যন্ত্র ছিল। তারাই সুযোগটা করে দেয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় তৎকালীন মন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমেদের জড়িত থাকার কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আরো অনেকে এর মধ্যে জড়িত ছিল। ঘরের থেকে শত্রুতা না করলে বাইরের শত্রু সুযোগ পায় না। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সময় দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ছয় বছর প্রবাসে থাকার পর প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে বাবার দল আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। তারপর এখন তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। দেশের জনগণের উপর বিশ্বাস থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কখনো হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার কথা ভাবতে পারেননি বলে জানান তার মেয়ে। শেখ হাসিনা বলেন, অনেকেই তাকে সাবধান করেছিলেন; এরকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি বিশ্বাসই করেননি। আব্বা বলতেন, না, ওরা তো আমার ছেলের মতো, আমাকে কে মারবে? পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসররাই জাতির জনককে হত্যা করেছিল, বলেন শেখ হাসিনা। এই হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের অনেকের নিয়মিত ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার কথাও উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। ডালিম (শরিফুল হক ডালিম), ডালিমের শ্বাশুড়ি, ডালিমের বউ, ডালিমের শালী ২৪ ঘণ্টা আমাদের বাসায় পড়ে থাকত। ডালিমের শ্বাশুড়ি তো সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত … ডালিমের বউ তো সারাদিনই আমাদের বাসায়। নিজের ভাই শেখ কামালের সঙ্গে খুনি মেজর এ এইচ এম বি নূর চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীর এডিসি হিসাবে কাজ করার কথাও বলেন শেখ হাসিনা। আরেক খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী এ আর মল্লিকের শালীর ছেলে। খুব দূরের না। এরাই ষড়যন্ত্র করল। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় দলের নেতৃত্ব থেকে শেখ হাসিনাকে বাদ দেয়ার ষড়যন্ত্রের জন্যও আওয়ামী লীগ কর্মীদের রোষের শিকার হয়েছিলেন কয়েক নেতা। পরে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি তাদের ক্ষমা করে দিলেও ভুলে যাননি। জিয়ার পারিবারিক সমস্যা সমাধানে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ নেওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমান প্রতি সপ্তাহে একদিন তার স্ত্রীকে (খালেদা জিয়া) নিয়ে ওই ৩২ নম্বরের বাড়িতে যেত।
বঙ্গবন্ধু বাড়ি দুয়ার সবার জন্য অবারিত ছিল, যার সুযোগ ষড়যন্ত্রকারীরা নিয়েছিল বলে জানান শেখ হাসিনা। তাদের যাওয়াটা আন্তরিকতা না.. চক্রান্ত করাটাই ছিল তাদের লক্ষ্য; সেটা বোধ হয় আমরা বুঝতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, আব্বা যখন দেখেছেন, তাকে গুলি করছে, তারই দেশের লোক, তার হাতে গড়া সেনাবাহিনীর সদস্য, তার হাতে গড়া মানুষ, জানি না তার মনে কী প্রশ্ন জেগেছিল? স্বামী এম ওয়াজেদ মিয়ার গবেষণার কারণে ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই জার্মানিতে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা; ছোট বোন শেখ রেহানাও সেখানে গিয়েছিলেন বেড়াতে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দিন দুই বোন ছিলেন বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে। খবর শোনার পর পশ্চিম জার্মানিতে ফিরে তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসায় উঠেন তারা। পরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের ভারতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এক দিনে পরিবারের সবাইকে হারানোর দিনটি মনে করতে গিয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখনও ততটা জানতে পরিনি কী ঘটে গেছে বাংলাদেশে। যখন জানতে পারলাম, তখন সহ্য করাটা কঠিন ছিল। ওই সময় তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেনের পশ্চিম জার্মানির বন শহরে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কথা চেপে রাখার কথাও বলেন শেখ হাসিনা। ১৯৮০ সালে বিদেশে থাকার সময়ই আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সভাপতি নির্বাচিত করা হয় রাজনীতির বাইরে থাকা শেখ হাসিনাকে। তিনি বলেন, এত বড় সংগঠন করার অভিজ্ঞতাও আমার ছিলে না। আমার চলার পথ অত সহজ ছিল না। দল এবং দলের বাইরে নানা প্রতিকূলতার কথা তুলে শেখ হাসিনা বলেন, খুনিরা বহাল তবিয়তে বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত। স্বাধীনতার বিরোধীরা তখন বহাল তবিয়তে। তারাই ক্ষমতার মালিক। যে পরিবারকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলো, সে পরিবারের একজন এসে রাজনীতি করবে। বক্তব্যের এই পর্যায়ে উপস্থিত নেতাদের আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব খুঁজতে বলেন শেখ হাসিনা; তবে সবাই সমস্বরে ‘না না’ বলে ওঠেন। শেখ হাসিনা বলেন, নতুন নেতৃত্ব খোঁজা দরকার। জীবন-মৃত্যু আমি পরোয়া করি না। মৃত্যুকে আমি সামনে থেকে দেখেছি। আমি ভয় পাইনি। আমি বিশ্বাস করি, আমার আব্বা আমাকে ছায়ার মতো আমাকে দেখে রাখেন, আর উপরে আল্লাহর ছায়া আমি পাই। “মেয়ের হাত ধরে দুটা সুটকেস নিয়ে চলে আসি। আমি মনে করি, আমাকে যেতে হবে, কিছু করতে হবে,” ৩৬ বছর আগের এই দিনটিতে দেশে ফেরার কারণ ব্যাখ্যা করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।