সুফিয়া কামাল স্মারক বক্তৃতায় বক্তারা বলেছেন, বৈশ্বিক নারী আন্দোলনে সুফিয়া কামাল সবসময়ই প্রাসঙ্গিক। জননী সাহসিকা বেগম সুফিয়া কামালের ১১৩ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে “সুফিয়া কামাল স্মারক বক্তৃতা ও সুফিয়া কামাল সম্মাননা” প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম-এর সভাপতিত্বে সভায় “নারীর প্রতি প্রচলিত গৎবাঁধা দৃষ্টিভঙ্গী : সুফিয়া কামালের আন্দোলন” শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আইনুন নাহার।
ড. আইনুন নাহার বলেন, সুফিয়া কামালকে বুঝতে হলে তাঁর বহুমাত্রিক সত্বাকে বুঝতে হবে। তাঁর বিভিন্ন লড়াই আন্দোলনকে বুঝতে হবে। বাংলাদেশের নারী আন্দোলনে যেমন তিনি সবসময় পথ প্রদর্শন করে চলেছেন, তেমনি বৈশি^ক নারী আন্দোলনেও তিনি সবসময়ই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু আমরা তাঁকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করতে ব্যার্থ হয়েছি। বর্তমান বাস্তবতায় বৈশি^ক নারী আন্দোলনে সুফিয়া কামালকে পরিচিত করতে হবে। তিনি বলেন, সুফিয়া কামাল শৈশবকাল থেকে তাঁর জীবনব্যাপী নারীকে যে গৎবাঁধা ছকে ফেলে দেখা হয়, তার সীমানা ভেঙ্গেছেন। তিনি প্রশবিদ্ধ করেছেন সামাজিক রীতিনীতিকে, পাশাপাশি সহনশীল ও অটল মনোভাব থেকেই বাস্তবতার নিরিখে নারীর অধিকার ও সামাজিক ন্যায় বিচারের জন্য লড়াই করেছেন।
সুফিয়া কামাল খুব অল্প বয়স থেকেই বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকে পুরুষের আধিপত্যশীল পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিসরে গৎবাঁধা লিঙ্গীয় মতাদর্শ ও চর্চাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। লিঙ্গীয় অসমতার বিরুদ্ধে তাঁর নানামুখী নিরলস কার্যক্রম বাংলাদেশের নারী সমাজকে নিরন্তর লড়াই করতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আইনুন নাহার বলেন, তাঁর বহু মাত্রিক সত্ত্বা ও সম্পৃক্ততা, তাঁর লেখনী, নারী আন্দোলনের পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই নিয়ে আরো গভীরভাবে অনুসন্ধান ও গবেষণা করা আজ সময়ের দাবি। এই কাজ কেবল চলমান নারী আন্দোলনকেই নয় বরং নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং বৈশি^ক পরিসরকেও প্রভাবিত করবে।
মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেমের সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। এবছর সুফিয়া কামাল সম্মাননা প্রদান করা হয় প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং প্রয়াত স্থপতি কবি রবিউল হুসাইনকে। প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ অসুস্থ থাকায় তার পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন তার কন্যা সাইকা মাহমুদ এবং প্রয়াত স্থপতি কবি রবিউল হুসাইনের পক্ষে তার পুত্র জিসান হুসাইন রবিন সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন। সম্মাননা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের পরিচিতি পাঠ করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রকাশনা সম্পাদক সারাবান তহুরা এবং প্রশিক্ষণ গবেষণা ও পাঠাগার সম্পাদক রীনা আহমেদ।
ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, সুফিয়া কামাল আজীবন নারী-পুরুষের স্বাধীনতা, সাম্য ও শান্তির জন্য লড়াই করেছেন। গৎবাধা লিঙ্গীয় নির্মাণ কিভাবে সমাজ জীবন ও কর্মকান্ডকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করে তা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। এসকল কুপ্রথার মধ্য থেকে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রথা ভেঙে এগিয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন এবং পথ নির্মাণ করেছেন। নারী আন্দোলন সামাজিক আন্দোলনেরই অংশ। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, আইন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন -এসবই নারী আন্দোলনের সাথে একই সূত্রে গাঁথা। তিনি বলেন, যেদিন সমাজ থেকে সব ধরণের বৈষম্য নিরসন হবে এবং নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হবে, সেদিনই সুফিয়া কামালের আন্দোলনের সঠিক মূল্যায়ণ হবে।
মালেকা বানু বলেন, সুফিয়া কামাল-এর বিশাল কর্মময় জীবন ও তার অংশবিশেষ নতুন প্রজন্মের নিকট তুলে ধরার লক্ষ্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রতি বছর তাঁকে স্মরণ করে স্মারকবক্তৃতা ও সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে । তিনি ছিলেন এক অতুলনীয় মানবিক গুণাবলির অধিকারী, যার ভেতরে থাকা আত্মশক্তিকে কোন শাসকগোষ্ঠী কখনোই উপেক্ষা করতে পারেননি। তিনি বলেন পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীরা যেখানে লেখক হিসেবে, কবি হিসেবে উপেক্ষিত, এমন এক সমাজে সুফিয়া কামাল কবি হিসেবে লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করোছেন, স্বীকৃতি আদায় করেছেন এবং নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি নারীর প্রতি প্রচলিত বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করে বর্তমান প্রজন্মকে সুফিয়া কামালের দেখানো পথ অনুসরণ করে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে কবি সুফিয়া কামালের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেতৃবৃন্দ। এসময় কবি সুফিয়া কামালকে নিয়ে তৈরি করা প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ইফ্ফাত আরা দেওয়ান এবং বিশিষ্ট নজরুল সংগীত শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। আবৃত্তি করেন বাংলা শুদ্ধ উচ্চারণ গবেষক ও আবৃত্তিকার গোলাম সারোয়ার।